ঈদপূর্ব শেষ কর্মদিবস ছিল গতকাল। তাই অফিসে হাজিরা দিয়েই অনেকে রওনা হয়েছেন বাড়ির পথে। তবে পথে পথে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। দিনের শুরুটা হয়েছে বৃষ্টি দিয়েই। এর জেরে সময়মতো বাস ছাড়েনি টার্মিনাল থেকে। মহাসড়কে তৈরি হয়েছে যানজট। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ভোগের মাত্রাও বেড়ে গেছে।
প্রতিবারের মতো এবারও সড়ক পথে ভিড়, যানজটের ভোগান্তি। আর ট্রেন সময়সূচি না মেনে চলার ঘটনা ঘটেই চলেছে। এবার দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে টানা বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতা। এতসব ভোগান্তির পরও গতকাল বৃহস্পতিবার ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে স্টেশনে, টার্মিনালে। আজ শুক্রবার যাত্রীচাপ আরও বাড়তে পারে।বৃষ্টিপাতের কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ বেকায়দায় পড়েন ঢাকা ছাড়তে চাওয়া মানুষগুলো। চাপের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে বাড়তি ভাড়া দিয়ে রেলস্টেশনে গিয়ে দেখেন
সময়মতো ট্রেন ছাড়ছে না। এই বিলম্বের বড় কারণ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রেললাইনে ধীরগতিতে ট্রেন চলাচল। তবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে ধীরে চালাতে হয়। ওঠা-নামায় লাগে বাড়তি সময়। তাই ট্রেন সময়মতো পৌঁছতে পারে না। ফলে স্টেশন থেকে ছাড়তে দেরি হয়। আর নৌপথের অবস্থা আবহাওয়ার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। বৈরী আবহাওয়ার কারণে সতর্কতার সঙ্গে লঞ্চ চালাতে হচ্ছে। এবার বাড়তি সতর্কতা হচ্ছে সড়ক, রেল ও নৌপরিবহনে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা ঠেকাতে স্প্রে প্রয়োগ। কিন্তু তা-ও মানা হচ্ছে না।
রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েদাবাদ, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল সর্বত্র ছিল মানুষের ঢল। বৃষ্টি মাথায় বাসা থেকে বেরোনোর বিড়ম্বনা ছিল চোখের পড়ার মতো। ব্যাগ-ব্যাগেজ, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নির্ধারিত সময়ের আগে কাউন্টারে পৌঁছার পর দেখেন কাক্সিক্ষত বাহনের হদিস নেই। আবার বৃষ্টিতে ভিজেও রওনা হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কারণ আগাম টিকিট কেনা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, পাবনা নাটোর, সিরাজগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের বাসগুলো যথাসময়ে ঢাকা ছেড়ে গেলেও বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পেছাতে থাকে সূচি। ঢাকাসংলগ্ন বাইপাইল মহাসড়কে যানজটের কারণে দুপুরের পর বাসগুলো ছাড়তে বিলম্ব হয় বলে বিভিন্ন পরিবহনের কাউন্টারকর্মীরা জানিয়েছেন।
সকাল থেকে গাড়িগুলো যথাসময়ে ছাড়লেও দুপুরের পর সাভার বাইপাইল এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। একদিকে বৃষ্টি, অন্যদিকে সড়কের বিভিন্ন স্থানে গরুবোঝাই ট্রাক। এটাই যানজটের কারণ।গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জলমগ্ন সড়কে গাবতলী, কল্যাণপুর গাড়ির নিশ্চল সারি। গাবতলী, কল্যাণপুর থেকে বাড়ি ফেরা বাস ধরতেই এমন ভিড়। একই অবস্থা ছিল তেজগাঁওয়ে। মহাখালী টার্মিনালে ঈদযাত্রার বাস ও যাত্রীদের চাপে তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে বনানী পর্যন্ত দিনভর ছিল তীব্র যানজট।
প্রায় একই চিত্র কমলাপুর রেলস্টেশনে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৯টার ‘রংপুর এক্সপ্রেস’ কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায় সাড়ে তিন ঘণ্টা দেরিতে, দুপুর সাড়ে ১২টায়। সকাল ৬টার রাজশাহীগামী ‘ধূমকেতু এক্সপ্রেস’ সোয়া তিন ঘণ্টা দেরিতে সকাল সোয়া ৯টায় ছাড়ে। পঞ্চগড়গামী ‘একতা এক্সপ্রেস’ও প্রায় তিন ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ে। ১০টার এই ট্রেনটি দুপুর ১টায় কমলাপুর ছাড়ে। ৬টা ২০ মিনিটের খুলনাগামী ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’ দুই ঘণ্টা দেরিতে, চিলাহাটিগামী ‘নীলসাগর এক্সপ্রেস’ দেরি করে তিন ঘণ্টা। পশ্চিমাঞ্চলের ১৮টি ট্রেনের প্রায় সব কয়টি এক ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত দেরিতে ছাড়ে।
ট্রেনগুলো সময়মতো ছাড়তে না পারায় কমলাপুর রেলস্টেশনে ছিল মানুষের উপচেপড়া ভিড়। নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই যাত্রীরা চলে আসেন রেলস্টেশনে। তিন-চার ঘণ্টাতেও ট্রেন না ছেড়ে যাওয়ায় সব ট্রেনের যাত্রীতে স্টেশন লোকে লোকারণ্য। এ ছাড়া বিলম্বজনিত কারণে ঘোষণা সত্ত্বেও ট্রেনে স্প্রে করা হচ্ছে না। মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবারের ঈদযাত্রায় স্টেশন থেকে ছাড়ার আগে ট্রেনে মশা মারার ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যায়নি। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, যাত্রীরা দ্রুত ট্রেন ছাড়ার তাগিদ দেওয়ার কারণে স্প্রে করা যাচ্ছে না।
একই চিত্রে বাসেও। হানিফ পরিবহনের কমলাপুর কাউন্টার ব্যবস্থাপক মোশাররফ হোসেন জানান, প্রতিটি বাস ঢাকায় ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রীতে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আধাঘণ্টা বিরতি দিয়ে আবার চালাতে হচ্ছে। এ কারণে মশার ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না।যাত্রীচাপ প্রসঙ্গে রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ৫৫টি আন্তঃনগর ও মেইল ট্রেনে ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এসব ট্রেনে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ ঢাকা ছাড়বেন। ঈদযাত্রায় যাত্রীর চাপ অনেক বেশি থাকায় যাত্রী ওঠানামায় সময় নষ্ট হচ্ছে বলে দাবি তাদের।
রাজধানীর কমলাপুর স্টেশনে দেখা যায়, ট্রেন আসামাত্র যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। দরজা-জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন কাঁধে ব্যাগ নিয়েই। কেউ কেউ নারী-শিশুদের ধরাধরি করে ট্রেনের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। বিমানবন্দর স্টেশনের অবস্থা আরও কঠিন। সেখানে ট্রেনের ছাদে ওঠারও চেষ্টা চলে। রেলওয়ে কর্মীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে যাত্রীরা ট্রেনের ছাদে, বগির সংযোগস্থল, ইঞ্জিনের পাশে উঠে পড়ছেন। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের তাড়না বৃষ্টিকে তুচ্ছ মনে হয়েছে তাদের কাছে।
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক জুয়েল বলেন, ঈদযাত্রায় বেশি মানুষের চাপ মোকাবিলা করতে হয়। যাত্রী বেশি হওয়ায় ট্রেনগুলো বিভিন্ন স্টেশনে থামলে যাত্রী ওঠানামায় আগের চেয়ে সময় অনেক বেশি লাগছে। ফলে ট্রেনগুলো ঢাকায় আসছে নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। তাই ছাড়তেও দেরি হচ্ছে।এদিকে সদরঘাট থেকে গতকাল শতাধিক লঞ্চ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে ছাড়ে। বৈরী আবহওয়ার কারণে ঝুঁকি নিয়েই লঞ্চগুলোকে চলাচল করতে হয়। সারাদেশে ৬৫ ফুটের নিচে লঞ্চ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ছিল।
গতকাল পদ্মার উত্তাল অবস্থা মাঝে মধ্যে সহনীয় মাত্রায় নেমে আসে। আগের রাত থেকে গতকাল দিনের একটা অংশ ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল শিমুলিয়া ঘাটে। এ কারণে দুই ঘাটে সড়কযান আটকা পড়ে। দক্ষিণাঞ্চলগামী বাস চলাচলে বিঘœ ঘটনায় মানুষ নৌপথে ঝোঁকে। এতে তুলনামূলক বেশি চাপ পড়ে লঞ্চগুলোয়। এর মধ্যে বাড়তি বিড়ম্বনা ছিল গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত যানজটের কারণে। বৃষ্টির কারণে দিনভর ভোগান্তি ছিল। মানুষ বাধ্য হয়ে হেঁটে হেঁটেই সদরঘাটে যান। নৌপথে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে ও শৃঙ্খলা রক্ষায় বিআইডব্লিউটিএর দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সদরঘাটে ছিলেন।