► চামড়াশিল্পে মোট ব্যাংক ঋণ ৭৭০৭ কোটি টাকা
► এই ঋণের বেশির ভাগই মাত্র ৭% সুদে দেওয়া
► তবু ৮০ শতাংশই খেলাপি
গদ টাকার অভাবে আড়তদারদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কেনা যাচ্ছে না বলে ট্যানারি মালিকরা সবার সামনে যেভাবে গলা শুকাচ্ছে, ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে এর মিল পাওয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দর পড়তির দিকে বলে যে তথ্য ট্যানারি মালিকরা শুনিয়ে আসছে, সেটিও সঠিক নয়। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক এ পর্যন্ত কাঁচা চামড়া কেনার জন্য ট্যানারি মালিকদের কত টাকা ঋণ দিয়েছে, সে তালিকা সংগ্রহ করেছে কালের কণ্ঠ। তাতে দেখা গেছে, এখন পর্যন্ত শুধু কাঁচা চামড়া কেনার জন্য তিন হাজার ৬১২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ট্যানারি মালিকরা। গত তিন মাসেই রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংক থেকে কাঁচা চামড়া কেনার জন্য ৫০০ কোটি টাকার মতো ঋণ দেওয়া হয়েছে ট্যানারি মালিকদের।
কিন্তু আড়তদাররা বলছে, তারা ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে তাদের বকেয়া পাওনার এক কানাকড়িও পায়নি। প্রশ্ন উঠেছে, যে টাকা চামড়া কেনার জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া হলো, সেই টাকা গেল কোথায়?
গত রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে টাকা না পাওয়া নিয়ে শিল্পমন্ত্রীর সামনে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় ও হট্টগোল হয় আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের। ওই সভার সূত্র বলছে, আড়তদাররা ট্যানারি মালিকদের কাছে জানতে চায়, ‘ব্যাংক থেকে আপনারা টাকা উঠিয়েছেন, কিন্তু আপনারা আমাদের বকেয়া পাওনা দিচ্ছেন না কেন?’ জবাবে ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সাভারে চামড়া শিল্প নগরীতে জমি বুঝে না পাওয়ায় ব্যাংক থেকে আশানুরূপ ঋণ পাওয়া যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর বাণিজ্য ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
গত রবিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সূত্রে জানা যায়, সেখানে ট্যানারি মালিকরা বলে, আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম কমে গেছে। তাই বাংলাদেশে এর চাহিদা কমে গেছে। প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে এক ডলারের নিচে বলা হয়। প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর ৫০ সেন্ট দাবি করে আসছে ট্যানারি মালিকরা। কিন্তু গত রবিবার ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রতি বর্গফুট চামড়ার দর দেড় থেকে দুই ডলারের মধ্যে।
ওই দিনের বৈঠকে বাণিজ্যসচিব মফিজুল ইসলামও ট্যানারি মালিকদের দেওয়া তথ্য সঠিক নয় বলে জানান। তিনি বলেন, ‘মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দর কমতির দিকে বলছে। কিন্তু আমাদের হাতে থাকা তথ্য বলছে চামড়ার দর কমছে না।’
গত ৩১ বছরের ইতিহাসে এবারের কোরবানির ঈদে সবচেয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি হয়। এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৩০০ টাকায়। চামড়ার দাম তলানিতে ঠেকায় চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। কেউ কেউ রাস্তার ওপর চামড়া ফেলে চলে যান। চামড়ার দাম নিয়ে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করতে থাকে। যদিও আগামী ২২ আগস্ট এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে বকেয়া টাকার বিষয়ে সুরাহা হওয়ার কথা রয়েছে।
কিন্তু কোন পক্ষের অভিযোগ সত্য এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, নগদ অর্থের সংকটের অজুহাত তোলা হলেও কাঁচা চামড়ার বিপর্যয়ের মূল কারণ ট্যানারি মালিকদের কারসাজি। কারণ তারা ব্যাংক থেকে টাকা পেলেও আড়তদারদের পাওনা সময়মতো পরিশোধ করেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, সার্বিকভাবে চামড়াশিল্পে এখন ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ সাত হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু কাঁচা চামড়া কেনার জন্যই ট্যানারি মালিকদের দেওয়া হয়েছে তিন হাজার ৬১২ কোটি টাকা। বাকি চার হাজার ৯৪ টাকা বিতরণ করা হয়েছে চামড়াজাত পণ্য তৈরিতে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যই বলছে, বিতরণ করা সাত হাজার ৭০৭ কোটি টাকার মধ্যে ৮০ শতাংশই খেলাপি। অথচ এই ঋণের বেশির ভাগই বিশেষ সুবিধায় মাত্র ৭ শতাংশ সুদে বিতরণ করা, যেখানে অন্য ব্যবসায় ব্যাংকঋণের সুদ ১ অঙ্কে নামানোর জন্য গলদঘর্ম হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সূত্র জানায়, ২০০৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলার জারি করে রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ ৭ শতাংশ বেঁধে দেয়। কাঁচা চামড়া কিনতেও এই সুদহারে ঋণ পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলাউদ্দীনের কাছে জানতে চাইলে গতকাল কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আড়তদারদের সঙ্গে আমাদের লেনদেনের সম্পর্ক এক দিনের নয়, ৫০ বছরের। দেনাপাওনা আছে এটা ঠিক, তবে সমাধানও আছে।’ ব্যাংকঋণের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়াশিল্প স্থানান্তরের কারণে আমরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ করতেই আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। সে কারণে অনেকেই ঋণখেলাপি হয়ে গেছে, পাশাপাশি আড়তদারদের বকেয়াও পরিশোধ করতে পারেনি।’
কালের কণ্ঠ’র হাতে আসা তথ্য বলছে, কাঁচা চামড়া সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক—এক হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংক দিয়েছে ৮৪২ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৪৫৫ কোটি আর ইসলামী ব্যাংক দিয়েছে ২৬৯ কোটি টাকা। আড়তদারদের দাবি, ট্যানারির মালিকদের কাছে তাদের পাওনা ৪০০ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, ট্যানারি মালিকরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তাও ফেরত দিচ্ছে না। চামড়া কিনতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নয়ছয় করা হচ্ছে। ট্যানারি খাতে আলোচিত ক্রিসেন্ট গ্রুপের তিন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকা অর্থপাচারের মামলা চলছে।
কারা কারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েও আড়তদারদের বকেয়া টাকা পরিশোধ করেনি তার খোঁজে কালের কণ্ঠ থেকে যোগাযোগ করা হয় চট্টগ্রাম, নাটোর, কুষ্টিয়া, নওগাঁসহ দেশের বড় বেশ কয়েকটি চামড়া মোকামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে, যারা তৃণমূল থেকে চামড়া সংগ্রহ করে ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করে। কুষ্টিয়া চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনিছ কোরাইশী চামড়া বিক্রি করেছেন ক্রিসেন্ট ট্যানারি, ঢাকা হাইডস, সামিনা ট্যানারি, মুক্তা ট্যানারি, আনোয়ার ট্যানারি, সোনার বাংলা ট্যানারির কাছে। এসব ট্যানারির কাছে ১৫ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে তাঁর। হতাশ কণ্ঠে আনিছ কোরাইশী গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব ট্যানারি মালিক মোবাইল ফোন বন্ধ করে রেখেছে। আমাদের বকেয়া টাকা পরিশোধ না করলে আমরা চামড়া বিক্রি করব না।’ তবে তিনি সরকারের কাছে দাবি করেন, এভাবে ট্যানারি মালিকদের ব্যাংক থেকে ঋণ না দিয়ে যারা তৃণমূল থেকে চামড়া সংগ্রহ করে তাদের ঋণ দেওয়ার। তাতে এ ধরনের অরাজকতা কিছুটা হলেও কমবে। চট্টগ্রাম চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, তাঁরা ট্যানারি মালিকদের কাছে ৩০ কোটি টাকা পাবেন। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা হাইডস, মিতালি ট্যানারি, সালমা ট্যানারি আইয়ুব ব্রাদার্স। কিন্তু এসব ট্যানারি থেকে এক টাকাও পাওয়া যায়নি।
গত ১৪ আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো চামড়া বেচাকেনায় ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার আরো বেশি দেওয়া হয়। তার পরও কেন চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে না, কেন কিনল না, এখন কেন কিনবে—এসব বিষয় বুঝতে হবে।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এবার যেসব সমস্যার মুখোমুখি হলাম, এগুলোকে দূর করার জন্য আগামীতে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
জনতা ব্যাংক গতকাল পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে ৪১ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে। এ ছাড়া আনোয়ার ট্যানারি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ৪১ কোটি, মুক্তি ট্যানারির নামে আট কোটি ও কুমিল্লা ট্যানারির নামে এক কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন।
রূপালী ব্যাংক চামড়া কিনতে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ২৩৩ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে। এগুলো হলো বেঙ্গল লেদার ১৫৬ কোটি, সামিনা ট্যানারি ৫৫ কোটি ও এইচ অ্যান্ড এইচ ট্যানারি ২২ কোটি টাকা। রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, যাদের থেকে ঋণ আদায় ভালো, তাদেরই ঋণ দেওয়া হচ্ছে।
কোরবানির চামড়া কিনতে এবার পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ১৩০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এগুলো হলো ঢাকা হাইডস অ্যান্ড স্কিনস ৪৫ কোটি, মেসার্স অ্যাপেক্স ট্যানারিজ ৬০ কোটি, বে-ট্যানারিজ ১৫ কোটি, মেসার্স ফেন্সি লেদার এন্টারপ্রাইজ পাঁচ কোটি ও দোয়েল ইন্টারন্যাশনাল দেড় কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক আমিন ট্যানারিকে ২৫ কোটি, কালাম ব্রাদার্সকে ২০ কোটি ও ভুলুয়া ট্যানারিকে ২৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। আগের বছরও এ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে একই পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক উবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। চামড়া কিনতে বেসরকারি বেশ কিছু ব্যাংকও ঋণ দিয়ে আসছে।
কোরবানির ঈদের আগে থেকেই চামড়া কেনার টাকা নেই বলে দাবি করে আসছে এ খাতের উদ্যোক্তারা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর এ খাতে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হচ্ছে তার বড় অংশই ফেরত আসছে না। গত দুই-তিন বছর এ খাতে দেওয়া ঋণ কিছুটা ফেরত এলেও আগের নেওয়া ঋণের বেশির ভাগই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাহলে ব্যাংকঋণের এত টাকা গেল কোথায়? তাহলে কি এ খাতের ঋণের টাকাও অন্য খাতে ব্যবহার হয়েছে, নাকি বিদেশে পাচার হয়েছে?
জানতে চাইলে ফেন্সি লেদারের স্বত্বাধিকারী শামসুল হুদা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি পাঁচ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছি। তবে এখনো টাকা উঠাইনি। আমি চিকিৎসার জন্য বাইরে যাচ্ছি। ২৫ আগস্ট ফিরব। তারপর টাকা বিতরণ করব।’
কুমিল্লা ট্যানারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমানকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছি। আড়তদারদের বকেয়া পরিশোধের প্রক্রিয়া চলছে।’