মাত্র এক দশক আগেও ছিলেন বালু শ্রমিক। তুরাগ নদ থেকে বালু তুলে পারে এনে বিক্রি করতেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তুরাগ থানার দিয়াবাড়ী, নয়ানগর এলাকার ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা গডফাদার। আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আরোহণ তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেয়। হঠাৎ বিত্তবান এই হাইব্রিড কোটিপতি নেতার নাম নুর হোসেন। বর্তমানে তিনি তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের (প্রস্তাবিত কমিটি) অর্থবিষয়ক সম্পদক। নুর হোসেন বিত্তবান ও ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন রাজনৈতিক পরিচয়ে। গড়ে তুলেছেন বিপুল ভূ-সম্পদ, পাকা বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। হয়ে উঠেছেন চিহ্নিত চাঁদাবাজ-দখলবাজ।
একদা বালু শ্রমিক, ২০০৮-এ আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া নুর হোসেন বর্তমানে দিয়াবাড়ী-নয়ানগর এলাকায় (উত্তরা সেক্টর-১৫) তিনটি বাড়ি ও একটি প্লটের মালিক। এর মধ্যে একটি বাড়ি ছয়তলা, একটি পাঁচতলা, আরেকটি সাততলা (নির্মাণাধীন)। আর উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টরে রয়েছে একটি প্লট। এ ছাড়া আশুলিয়ার কাঠগড়া মৌজায় রয়েছে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের এক একর জমি, পুবাইলের মাজুখান এলাকায়ও রয়েছে তাঁর এক বিঘা জমি। উত্তরার ১৫ নম্বর সেক্টরে বর্তমানে কাঠাপ্রতি জমির মূল্য এক কোটি টাকা। সে হিসাবে পাঁচ কাঠা করে দিয়াবাড়ী ও নয়ানগরে তিনটি বাড়ির ১৫ কাঠা জমির মূল্য ১৫ কোটি টাকা। ১৭ নম্বর সেক্টরে পাঁচ কাঠা প্লটটির মূল্য পাঁচ কোটি টাকা। আশুলিয়ায় এক বিঘা জমির মূল্য ১০ কোটি টাকা এবং পুবাইলের মাজুখানে এক বিঘা জমির মূল্য আট কোটি টাকা। তিনটি বাড়ির ভবন নির্মাণে খরচ হয়েছে গড়ে চার কোটি টাকা করে ১২ কোটি টাকা। মোট হিসাবে শুধু তাঁর ভূ-সম্পত্তির মূল্যই ৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। উত্তরার শিন শিন জাপান হাসপাতালের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক তিনি। বর্তমানে নুর হোসেনের মালিকানায় রয়েছে একটি প্রাডো জিপ ও একটি প্রাইভেট প্রিমিও গাড়ি।
বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে বহুবার বলেছেন, নব্য যেসব অনুপ্রবেশকারী দলে আছে, সামনের কাউন্সিলে ওই সব নেতার আর দলে জায়গা হবে না।’
কদিন আগে কোরবানির ঈদে উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে গরুর হাট ইজারা নেন নুর হোসেন। ওই সময় অন্য কেউ দরপত্র দাখিলেরই সাহস পায়নি।
বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার পরও চাঁদাবাজি ছাড়েননি নুর হোসেন। দিয়াবাড়ী এলাকার লেকপাড়ে ফুচকাসহ অন্য খাদ্যদ্রব্যর ২০টি দোকান বসিয়েছেন তিনি। প্রতিটি দোকান থেকে নুর হোসেন মাসে ভাড়া আদায় করেন ১০ হাজার টাকা করে। একাধিক দোকানি কালের কণ্ঠকে জানায়, তাদের কাছ থেকে সরাসরি ভাড়া আদায় করেন নুর হোসেন। এ ছাড়া দিয়াবাড়ী লেকে ২৫টি ইঞ্জিনচালিত বোট আছে বিনোদনপিপাসুদের জন্য। এই বোটগুলো থেকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে আদায় করেন নুর হোসেন। এ ছাড়া নবঘোষিত উত্তরা ১৫ নম্বরে সেক্টর (নয়ানগর-দিয়াবাড়ী) এলাকায় প্রায় ২০টি সরকারি প্লট দখলে নিয়েছেন নুর হোসেন।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কমাস পর তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসেম চেয়ারম্যানের হাত ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নুর হোসেন। এর পরই দিয়াবাড়ী-নয়ানগর এলাকার অপরাধজগৎ দাপিয়ে বেড়ানো ১১৭ জন সন্ত্রাসী-ছিনতাইকারী, খুনির আশ্রয়দাতা হয়ে ওঠেন নুর হোসেন। ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এজাজ, সাগর, রিপন, সালাউদ্দিন, স্বাধীন, সালাম, রানা, রনি, বাপ্পী বর্তমানে নুর হোসেনের সার্বক্ষণিক সহযোগী।
উত্তরার দিয়াবাড়ীর প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখতে যাওয়া ভ্রমণপিপাসু মানুষকে বিপদে ফেলে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া, ওই এলাকায় চলাচলকারী সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের মালপত্র ছিনতাই, চলাচলকারী যানবাহনের সামনের গ্লাসে ঢিল ছুড়ে গাড়ি থামিয়ে ছিনতাই—এসব অপরাধে জড়িত দিয়াবাড়ী এলাকার ওই অপরাধীচক্র। গত ৪ মার্চ এক র্যাব কর্মকর্তার গাড়িতে ঢিল ছুড়ে ছিনতাইচেষ্টার সময় গ্রেপ্তার হয় স্বাধীনসহ দলের ১১ সদস্য। নুর হোসেনের অন্যতম সহযোগী এজাজ দেখভাল করে তাঁর মাদক কারবার। আর অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ও করে সে।
খুন, ধর্ষণ, অপহরণসহ নানা অপরাধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ১৮টি মামলা রয়েছে এজাজের বিরুদ্ধে। অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য এজাজের রয়েছে টর্চার সেল। দিয়াবাড়ী বিআরটিএ অফিসের পাশে ‘বন্ধু নার্সারি’। ওই নার্সারির মালিককে হটিয়ে এজাজ নার্সারির ভেতরে চারটি রুম তৈরি করেছে। ওই রুমগুলো তার টর্চার সেল। গত ১৫ জানুয়ারি টঙ্গীর হোসেন মার্কেট এলাকা থেকে লতিফ নামের এক যুবককে অপহরণ করে এজাজ। তাঁকে তিন দিন টর্চার সেলে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। পরে ওই যুবকের বাবার কাছ থেকে চার লাখ ৬৫ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
‘বন্ধু নার্সারি’ এলাকার অনেকে জানান, মাঝেমধ্যে ওই টর্চার সেল থেকে কান্নার শব্দ শোনা যায়। গত বছর ৪ জুলাই আবদুর রউফ নামের এক যুবকের লাশ পাওয়া যায় দিয়াবাড়ী এলাকায়। পুলিশ তাঁর সঙ্গে থাকা আইডি কার্ড থেকে জানতে পারে, তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী। তুরাগ থানার পুলিশ ওই হত্যাকাণ্ডে নুর হোসেনের সহযোগী এজাজের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পরও অজ্ঞাত কারণে তদন্ত কর্মকর্তাকে তুরাগ থানা থেকে বদলি করা হয়।
নুর হোসেন তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের (প্রস্তাবিত কমিটি) অর্থবিষয়ক সম্পদক। তুরাগ থানা ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের অধীনে। নুর হোসেনদের মতো নেতারা কিভাবে দলের পদ পান—এমন প্রশ্ন করা হলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মহানগরে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নাম অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কোনো থানায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। যাঁদের বিরুদ্ধে অনৈতিকতা ও দলের নাম ব্যবহার করে বাণিজ্য করার অভিযোগ আছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে তাঁরা কমিটি থেকে বাদ পড়বেন।’
জানতে চাইলে নুর হোসেন কালের কণ্ঠ’র এই প্রতিনিধিকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘আমার কয়টা বাড়ি আছে, আর কী সম্পদ আছে, আগে বালু শ্রমিক ছিলাম, না কী ছিলাম, এগুলো জানার আপনি কে? যা ইচ্ছা লেখেন। আর লেখার ক্ষমতা আপনার নাই। আপনার চেয়ে বড় বড় সাংবাদিকদেরও আমি থোড়াই কেয়ার করি। আপনার লেখা আপনার পত্রিকাতেই প্রকাশের ক্ষমতা রাখেন না আপনি। একটু পরেই আপনি ফোন পাবেন।