নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে অনন্য নজির সৃষ্টি করা আমতলীর মনিকা বিদ্যালয়ে ফিরেছে। তাকে কাছে পেয়ে আনন্দিত তার সহপাঠী ও বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
রোববার মনিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস করেছে। তাকে নিয়ে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও শিক্ষকের মাঝে কৌতূহলের শেষ নেই।
সবার ভাষ্য দ্বিতীয় শ্রেণির একটি মেয়ে এতবড় সাহসী পদক্ষেপ কীভাবে নিতে পারে? সাহসীকন্যা মনিকা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জীবনে বড় কিছু হতে পারবে বলে তাদের ধারণা।
আমতলীর সর্বমহলে আলোচিত একটি নাম সাহসীকন্যা মনিকা। সরকারের কাছে সচেতন নাগরিকের দাবি মনিকাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারি সহযোগিতা দেয়া।
জানা গেছে, উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের অফিস বাজার এলাকার রিকশাচালক জুয়েল প্যাদা আমতলী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বটতলা ব্রিজ সংলগ্ন খালের পাড়ের বাসুগী গ্রামে একটি ভাড়া বাসায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করছেন। স্ত্রী শাহানাজ বেগম আমতলী পৌরসভায় পরিছন্নকর্মী হিসেবে দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন।
স্বামী-স্ত্রীর আয়ে কোনো মতে চলে তাদের সংসার। তাদের একমাত্র কন্যা মনিকা পৌরসভার আমতলী এমইউ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
অভাবেব সংসারে ৯ বছরের কন্যা মনিকা হয়ে পড়ে তাদের বোঝা। এতটুকু বয়সে কিছু বোঝার আগেই সিদ্ধান্ত নেয় মা শাহানাজ মেয়েকে বিয়ে দেয়ার।
মনিকার মা পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মী শাহনাজ বেগম একই পৌরসভার আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী শামীমের (১৫) সঙ্গে মেয়ের বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করেন।
এ বিয়েতে মনিকার বাবা রাজী ছিলেন না বলে জানায় মনিকা। নিজের বিয়ের এ আয়োজন দেখে মনিকা চমকে যায় এবং তার এ বিয়ে বন্ধের জন্য একই এলাকার খেলার সঙ্গী ফারজানা ও কনিকাকে নিয়ে আমতলী থানায় চলে আসে।
থানায় এসআই নাসরিনের সঙ্গে দেখা হলে মনিকা তার বিয়ের আয়োজনের সব কথা খুলে বলে। তাৎক্ষণিক এসআই নাসরিন কয়েকজন পুলিশ সদস্য নিয়ে মনিকার বাড়িতে চলে যান।
ঘটনাস্থলে গিয়ে এসআই নাসরিন বিয়ের সব আয়োজনের সত্যতা পান। এসআই নাসরিন তাৎক্ষণিক আমতলী ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কমলেশ চন্দ্র মজুমদারকে জানান।
ভ্রাম্যমাণ আদাতের বিচারক কমলেশ মজুমদার ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি মনিকার মাকে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেন। পরে বাল্যবিয়ের কুফল বুঝতে পেরে মনিকার মা তার মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিবেন না বলে মুচলেকা দেন।
নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর ঝামেলার কারণে শনিবার বিদ্যালয়ে আসেনি মনিকা। রোববার বিদ্যালয়ে আসায় তার সহপাঠীরা তাকে কাছে পেয়ে আনন্দিত হয়।
শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকের মাঝে দেখা দিয়েছে নতুন উদ্দীপনা ও কৌতূহল। তাকে নিয়ে গর্ববোধ করছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
রোববার বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, মনিকা তার সহপাঠীদের নিয়ে শ্রেণিকক্ষে বসে আছে। শিক্ষক তাদের পাঠদান করছেন।
বিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে মনিকা বলেন, আমার মনের জোরেই আমি থানায় গিয়েছি। আমি বুঝতে পারছি আমার মা একটি বড় অন্যায় করছেন। থানায় গেলেই সব সমাধান হবে। তাই হয়েছে। মনিকা আরও বলেন, আমি লেখাপড়া করে মানুষ হতে চাই। আমি নিজের বিয়ে ঠেকিয়েছি। কোথাও বাল্যবিয়ের খবর পেলে আমি ওই বিয়েও বন্ধ করব।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) মো. রিয়াজুল ইসলাম রাসেল বলেন, মনিকা যে কাজটি করেছে তা সমাজের জন্য একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। ওইটুকু মেয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে এতবড় কাজ করেছে এটা ভাবাই যায় না।
তিনি আরও বলেন, এ রকম মনিকা যুগে যুগে জন্ম নেয় না। ওর এতবড় কাজে বিদ্যালয়সহ গোটা আমতলীবাসী ধন্য। আমতলী উপজেলা নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহাবুদ্দিন পান্না বলেন, দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী মনিকা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যা অকল্পনীয়। মনিকার লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার জন্য সব ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আমতলী উপজেলা নির্বাহী আফিসার মোসা. মনিরা পারভীন বলেন, মনিকার শিক্ষাসহায়তা কার্যক্রম চলমান রাখব। মনিকার যেন লেখাপড়ায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটে সেই দিকে দেয়াল রাখা হবে।