রাজধানীর পল্টন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। চাকরি দেওয়ার কথা বলে ওই তরুণীকে ঢাকায় এনে একটি হোটেলে নিয়ে ধর্ষণ করেছেন বলে অভিযোগে জানা গেছে। পরে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ওই তরুণীর সঙ্গে মাসের পর মাস শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন তিনি।
ওই তরুণীর অভিযোগ, তিনি অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়লে ওসি মাহমুদুল গর্ভপাতের শর্তে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিলে তিনি গর্ভপাত করান। তবে এরপর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও তিনি আর বিয়ে করেননি। একপর্যায়ে ওই তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দেন ওসি মাহমুদুল। শেষ পর্যন্ত ওই তরুণী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর অভিযোগ করেছেন ওসির বিরুদ্ধে। তদন্তে সে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে, জমা পড়েছে তদন্ত প্রতিবেদনও। এরপরও মাহমুদুল হক পল্টন থানার ওসি হিসেবে বহাল তবিয়তেই কাজ করে যাচ্ছেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একাধিক সূত্র, মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগের তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগী ওই তরুণীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভুক্তভোগী তরুণী সাংবাদিকদের অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি সরকারি একটি কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করে চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ওসি মাহমুদুল হক আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর তিনি চাকরি দেওয়ার কথা বলে আমাকে ঢাকায় ডেকে আনেন। আমাকে রাখার জন্য পল্টনের ক্যাপিটাল হোটেলের একটি রুমে নিয়ে যান। সেখানে হোটেল বয়কে দিয়ে আমার জন্য স্যুপ নিয়ে আসান। আমি খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়ান। এরপরই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।’
ওই তরুণী বলেন, ঘুম ভাঙলে দেখি রাত ২টার মতো বাজে। ওই সময় মাহমুদুল হক আমার পাশেই শুয়ে ছিলেন। আমি বুঝতে পারি, ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হয়েছি। মাহমুদুল হকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন। তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয় জানিয়ে তিনি আমাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেন।
ওই তরুণীর অভিযোগ, এরপর প্রতি সপ্তাহেই ওই তরুণীকে ঢাকায় ডেকে এনে একই হোটেলে নিয়ে যেতেন মাহমুদুল হক। গত বছরের অক্টোবর মাসে তিনি বুঝতে পারেন, অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়েছেন। এ কথা মাহমুদুল হককে জানালে তিনি ওই তরুণীকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গর্ভপাত করতে বলেন এবং একপর্যায়ে তার কথায় রাজি হয়ে গর্ভপাত করান ওই তরুণী। তিনি জানান, দু’জনের সম্মতিতে তাদের মধ্যেকার শারীরিক সম্পর্কের ভিডিও ও ছবিও ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো ওই তরুণীর কাছে রয়েছে।
ওই তরুণী বলেন, মাহমুদুল হক বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিলেও আমাকে বিয়ে করেননি। সবশেষ গত ২ এপ্রিল আমার সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ করেন দেন। আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছি এসময়। পরে আমার পরিবার সবকিছু জানতে পারলে তারা মাহমুদুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এসময় আমার পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়, পল্টন থানার ওসির অনেক ক্ষমতা, বাড়াবাড়ি করলে আমার অনেক ক্ষতি হবে। আমি ঢাকার বাইরে একটি চাকরি করছি। সেখানেও আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেছেন মাহমুদুল হক।
ওই তরুণী বলেন, সবশেষে বাধ্য হয়ে আমি মতিঝিল জোনের এডিসি শিবলী নোমানকে বিষয়টি জানাই। তিনি বিষয়টি মীমাংসা করে দেবেন বলেও জানান। মাহমুদুলের বাবাকেও বিষয়টি জানাই। তবুও কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমি আইজিপি বরাবর লিখিত অভিযোগ করি। মাহমুদুল হক আমাকে বিয়ে না করলে আমি আদালতে মামলা করব।
ভুক্তভোগী তরুণীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়, পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে ওসি মাহমুদুলের বিরুদ্ধে করা অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মোনালিসা বেগমকে। তদন্ত শেষ করে তিনি প্রতিবেদন ডিএমপি সদর দফতরে পাঠিয়েও দিয়েছেন। সেখান থেকে গত বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) প্রতিবেদনটি পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবেদনে মাহমুদুল হকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। পল্টনের হোটেল ক্যাপিটালে নিয়ে যাওয়া বিষয়ে ওই তরুণী যেসব তথ্য দিয়েছেন, তা ঠিক। প্রতি মাসেই ওই হোটেলে ওসি পল্টনের নামে এক বা একাধিক দিন বুকিংয়ের তথ্য মিলেছে। তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ এ বছরের ১৭ মার্চ ওই হোটেল থেকে চেকআউট করেন ওসি মাহমুদুল। এছাড়া কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও ওসি ওই তরুণীকে নিয়ে গিয়েছিলেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে প্রতিবেদনে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল হক রোববার রাতে সাংবাদিকদের বলেন, আমি সূক্ষ্ণ ষড়যন্ত্রের শিকার। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা ও বানোয়াট।
ওসি মাহমুদুলের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করেছেন সবুজবাগ জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোনালিসা। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘পল্টন থানার ওসি মাহমুদুল ও ভুক্তভোগী মেয়েটির ব্যাপারে তদন্ত শেষ করে ডিএমপি সদর দফতরে প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। তবে প্রতিবেদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারব না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি কেবল বলেন, তদন্তে ঘটনার প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।
ডিএমপির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এডিসি মোনালিসার তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার তা গত বুধবার পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর ওসি মাহমুদুলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।
ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, ওসি মাহমুদুল হক ২০০১ সালে এসআই পদে পুলিশে যোগ দেন। তার বাড়ি নওঁগা জেলায়। চাকরি জীবনে তিনি একটি গুরুদণ্ড-ব্ল্যাক মার্ক এবং ২২টি লঘুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। তিনি ২০১৭ সালের ২ জুলাই পল্টন থানার ওসি হিসেবে যোগ দেন। তার স্ত্রী ও এক সন্তান রয়েছে।
সূত্র: সারাবাংলা