একজন ডা. মশিউর রহমানের কথা বলছি। দোবিলা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ডা. মশিউর রহমানের নানা বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। নানার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছেন। সেজন্যই দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে এই করোনাভাইরাস নামক যুদ্ধে সামনে থেকে কাজ করার জন্য নিজের মধ্যেই একটি তাগিদ অনুভব করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কীভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন অবশেষে সাহস করে মহাপরিচালক বরাবর বদলির জন্য আবেদন করেন। আবেদনপত্রের লেন, ঢাকা নারায়ণগঞ্জ গাজীপুর জেলায় করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য যে ডাক্তারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে সেজন্য ওই যে কোনো একটি জেলায় কাজ করতে আমি ইচ্ছুক। আবেদনে সাড়া দিয়ে দ্রম্নতই ডা. মসিউরকে নারায়ণগঞ্জ বদলি করা হয়। তিনি এখন নারায়ণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে করোনা রোগীদের নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এরকম আরও অনেক ডাক্তারই আমরা খুঁজে পাব, যারা নিষ্ঠার সঙ্গে নীরবে-নিভৃতে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
ডাক্তার-নার্স শুধু একটা চাকরি নয়, এটি একটি মহান সেবা। পৃথিবীর সর্বত্রই চিকিৎসকদের মাঠে কাজ করার আগে ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী একটি শপথ করতে হয়, ‘আমি মানবতার সেবায় আমার জীবন উৎসর্গ করলাম। আমার রোগীর স্বাস্থ্য হবে আমার প্রথম বিবেচনা। রোগীর প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোনো অবস্থাতেই বয়স, রোগ বা অক্ষমতা, ধর্মবিশ্বাস, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, লিঙ্গ, জাতীয়তা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বর্ণ, যৌন দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অবস্থান বা অন্য কোনো কিছু বিবেচনায় আনবো না’।
সারাবিশ্ব কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত। এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবুও ডাক্তারসহ স্বাস্থ্যসেবকরা দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। অবশ্যই এ যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডাক্তার-নার্স ও স্বাস্থ্য বিভাগের সেবকরা। উন্নত দেশগুলোতেও দেখতে পাচ্ছি অনেক ডাক্তার-নার্স সেবা দিতে গিয়ে মৃতু্যবরণ করেছেন। আমাদের দেশেও এক হাজারের উপরে ডাক্তার, নার্সসহ সেবাদানকারী কর্মীরা আক্রান্ত ইতিমধ্যে হয়েছে এবং দুজন প্রতিভাবান ডাক্তার সিলেট এসএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মঈনউদ্দিন ও আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজের হেমোটোলজিস্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কর্নেল (অব) মো. মনিরুজ্জামান করোনাযুদ্ধে জীবন দিয়েছেন।
অনেকেই অভিযোগ করছে ডাক্তার, নার্সরা সঠিকভাবে রোগীর সেবা দিচ্ছেন না। অভিযোগ থাকবে, সমস্যাও থাকবে। তারপরও কিন্তু ডাক্তাররাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাতেৃণ। একজন নার্সকে মায়ের ভূমিকা, বোনের ভূমিকা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। রোগীর সব ধরনের পরিচর্যা তাদের ওপর ন্যস্ত থাকে। চিকিৎসাব্যবস্থার দিক দিয়ে আমাদের দেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো থেকে হয়তো পিছিয়ে আছে। জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স নেই। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসাকেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নতমানের হাসপাতাল স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যসেবায় এনেছেন বৈপস্নবিক পরিবর্তন।
চিকিৎসকরা দেবতা নয়, আমাদের মতোই মানুষ। আমাদের কারও ভাই, কারও বোন। তাদেরও ভুলত্রম্নটি থাকতে পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে তাদের দোষী করা যাবে না। আপনার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যাই থাকুক না কেন অসুস্থ হলে কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। তাদের কোনো ছুটি নেই। ঈদ, পুজো নেই। হাসপাতালে বসে থাকতে হচ্ছে অসুস্থ লোকের সেবা করার জন্য।
পৃথিবীর সর্বত্র বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য ডাক্তাররা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা সীমিত করেছেন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছেন তার অধিকাংশ হাসপাতাল কিংবা চেম্বারে রোগী দেখে আক্রান্ত হয়েছেন। যারা সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন তাদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। জনগণের অসচেনতায় দিন দিন ডাক্তাররা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। সেজন্য জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চালু হয়েছে টেলি-মেডিসিন সেবা। সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও ৮৭ জনবিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের নিয়ে চালু করেছে টেলি-মেডিসিন সেবা কার্যক্রম।
করোনাভাইরাসের যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক তৈরি হয়নি, সেজন্য সচেতনতাই একমাত্র মুক্তির পথ। বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিন-রাত জনগণের মধ্যে সচেতনতা, করণীয় এবং প্রতিরোধের উপায়বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিয়ে মানুষের মধ্যে সাহস, শক্তি জোগাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুলস্নাহ, বঙ্গবন্দু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম বড়ুয়া এবং প্রখ্যাত লিভার বিশেষজ্ঞ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, লেখক, গবেষক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাবসহ (স্বপ্নীল) আরও অনেক বরেণ্য ডাক্তাররা সচেতনতা তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত নারী চিকিৎসক ডা. হামিদা মুস্তফা সেঁওতি করোনা পজিটিভ হওয়ার পর তার অনুভূতি প্রকাশ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, ‘এখন যদি মরেও যাই, আমার কোনো আফসোস থাকবে না। সবাই বলছে কাউকে বলো না। কেন বলব না? আমি তো কোনো দোষ করিনি। আমি আপনাদের সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছি। লকডাউনে যখন আপনারা বাড়িতে বসে সময় কীভাবে কাটাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তখন আমি হয়তো কোনো কোভিড-১৯ রোগীর পাশে দাঁড়িয়েছে। হঁ্যা আমি কোভিড-১৯ পজিটিভ। এতে আমার কোনো লজ্জা, ভয় বা আফসোস নেই। বরং আমি গর্বিত কারণ আমি শেষদিন পর্যন্ত কাজ করে এসেছি। আমি ডাক্তার হিসেবে যে শপথ নিয়েছিলাম তা আমি পালন করে এসেছি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ পাবো, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।
নববর্ষের দিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্বাস্থ্যসেবকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং মৃতু্য ঝুঁকি উপেক্ষা করে একেবারে সামনের কাতারে থেকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের পেশাটাই এরকম চ্যালেঞ্জের। এ ক্রান্তিকালে মনোবল হারাবেন না। গোটা দেশবাসী আপনাদের পাশে রয়েছে।
শুরুতে কিছুটা সমন্বয়হীনতার অভাব থাকলেও এখন কিন্তু ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সেবকরাই সামনে লড়াই করে যাচ্ছে। হঁ্যা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতারা, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, করোনার বিপক্ষে জিততে হলে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবকদের। তারাই তারকা, তারাই সুপার হিরো। আসুন তাদের উৎসাহ দিই, সাহস দিই, সম্মান জানাই।