ডেস্ক রিপোর্ট : দেশে মৌমাছির চাষ বাড়িয়ে মধু উৎপাদন বাড়াতে ইউরোপ গিয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে চান কৃষি মন্ত্রণালয়ের ৩০ কর্মকর্তা। আরও ১০০ কর্মকর্তা ইউরোপ যেতে চান শিক্ষা সফরে। সফরকালে শুধু মধু চাষ দেখাই নয়, তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জ্ঞান অর্জন করবেন তারা। জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে এই ১৩০ কর্মকর্তার ইউরোপ ভ্রমণে ব্যয় হবে সাড়ে ৬ কোটি টাকা। দেশ রূপান্ত
‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শিরোনামে কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেওয়া এক প্রকল্প প্রস্তাবে কর্মকর্তাদের ইউরোপ সফরের এই সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে এতে বাদ সেধেছে পরিকল্পনা কমিশন। তারা বলছে, প্রকল্পের আওতায় বিদেশগামীর সংখ্যা কমাতে হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৪৯৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে তেলজাতীয় ফসল উৎপাদন বাড়ানোর এই প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বিভিন্ন খাতে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাব রয়েছে জানিয়ে তা কমাতে বলেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। যেনতেন কাজে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণের প্রস্তাবের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিচ্ছেন তারা।
প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) ৪৪৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) ২০ কোটি ৪৪ লাখ, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) ১৫ কোটি ২১ লাখ ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বিভিন্ন খাতে ব্যয় করবে। প্রস্তাবের ওপর সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে চলতি বছরের জুন থেকে ২০২৪ সালের জুন নাগাদ। এই অর্থ দিয়ে দেশের ৬৪ জেলার ৪৭৬টি উপজেলায় ক্রপিং প্যাটার্নভিত্তিক ৯০ হাজার ১৪০টি প্রদর্শনী স্থাপন, ২৬ হাজার ৭২০ জন কৃষককে প্রশিক্ষণ, ৬ হাজার ৫৭০ জন কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ, ২১ হাজার ৬০০টি কৃষক মাঠ দিবস প্রশিক্ষণ, ১০০ কর্মকর্তার শিক্ষা সফর, ৩০ কর্মকর্তার মধু চাষবিষয়ক উচ্চতর প্রশিক্ষণ, ৫টি জাতীয় ও ৭০ আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ, বিএডিসির বীজ গুদাম মেরামত, ৭৮টি গাড়ি বা যানবাহন ক্রয়, বিভিন্ন তেলবীজ বিতরণ ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা হবে।
পিইসি সভায় বলা হয়, প্রস্তাবিত এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। তাই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে মৌমাছি চাষ বা মধু উৎপাদনের কোনো সম্পর্ক নেই। আর ডিএইর নেওয়া আরেকটি প্রকল্পে মৌচাষের কর্মকা- অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই প্রকল্পে তারা কতটা সফল হয়েছে, সেটা দেখতে হবে। এ ছাড়া মধুর চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি করা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কাজ। এ ক্ষেত্রে ডিএই শুধু তাদের সহায়তা করবে। তাই মধু চাষ টেকসই করার নামে বাণিজ্যিকীকরণ ডিএইর কাজ নয়। অথচ জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে এই মৌ চাষ শিখতে ডিএইর ৩০ জন কর্মকর্তা বিদেশে উচ্চ প্রশিক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন জনপ্রতি বরাদ্দ ঠিক রেখে কর্মকর্তার সংখ্যা কমিয়ে ৩০ থেকে ৪ জনে নামিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে। শর্ত দিয়ে বলেছে. এই ৪ জন অবশ্যই কৃষি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হতে হবে। অন্যরা কেউ যেতে পারবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি একাধিক বিভাগ বাস্তবায়ন করবে, এ জন্য বিদেশ সফরে সব বিভাগের প্রতিনিধি রাখতে গিয়ে সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে। তবে কোন দেশে যাবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরোপের কোনো একটি দেশে যেতে পারে। আর প্রস্তাব পাঠালেও পরিকল্পনা কমিশন যেহেতু অনুমোদন করেনি, তাই কমিশনের পরামর্শ মন্ত্রণালয় মেনে নেবে।
অন্যদিকে প্রকল্পের আওতায় উচ্চ বেতনে ৪ জন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ডিপিপিতে এসব পরামর্শকের বিদেশ ভ্রমণেও বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। পরিকল্পনা কমিশন পরামর্শক ৪ জনের জায়গায় ২ জন নিয়োগ দিয়ে তাদের বিদেশ সফর বাতিল করার পরামর্শ দেয়। এ ছাড়া অন্যান্য কর্মকর্তাও বিদেশে শিক্ষা সফর কমিয়ে ১০০ থেকে ৩৬ জনে নামিয়ে আনার কথা বলে দিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, সারা দেশের সব উপজেলায় তেলবীজ উৎপাদনের চিন্তা করা বাস্তবসম্মত নয়। এ জন্য আড়াই শ উপজেলাকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। যেখানে আনুপাতিক হারে প্রদর্শনী কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
প্রকল্পে প্রস্তাবনায় বেশ কয়েকটি খাতে মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় যৌক্তিক হারে কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে পিইসি সভায় বলা হয়েছে, প্রকল্পে প্রস্তাবিত ভিডিও ক্যামেরা, ডিএসএলআর ক্যামেরা, পরামর্শকদের বিদেশে শিক্ষা সফর, আনুষঙ্গিক ব্যয়, প্রতিটি জেলায় উপপরিচালক কর্তৃক বছর শেষে মেন্টরিং ও ফলোআপ আলোচনা, আঞ্চলিক ও জেলা মনিটরিং টিম গঠন করে ডিএইর কার্যক্রম মনিটরিং করার নামে আলাদা অর্থ বরাদ্দ বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ বাতিলের ফলে এসব খাতও রাখার প্রয়োজন নেই বলে মনে করে কমিশন। অন্যদিকে গাড়ি কেনার প্রস্তাব করলেও ড্রাইভার নিয়োগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকায় ২৫টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব ডিপিপি থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য মো. জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, আমরা দেখেছি, প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে অহেতুক ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় যৌক্তিক হারে কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছি। পরামর্শ অনুসারে সংশোধিত ডিপিপি পাঠালে সেই অনুসারে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে মোট ভোজ্যতেলের চাহিদা ৫১ দশমিক ২৭ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে উৎপাদন হয়েছে মাত্র আড়াই লাখ টন, বাকি ৪৬ দশমিক ২১ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করতে হয়েছে। দেশে তেল ফসলের মধ্যে সরিষা, চীনাবাদাম, তিল, তিসি, সয়াবিন ও সূর্যমুখী প্রভৃতি চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকেই সাধারণত তেল বানানো হয়। বর্তমানে দেশে আবাদি জমির মাত্র ৪ ভাগে তেল ফসলের আবাদ হয়। দেশে সামান্য পরিমাণ সয়াবিন উৎপন্ন হয়।
সুত্রঃ www.amadershomoy.com