দেশে কোনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই ভ্যাকসিন প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। ভ্যাকসিন আমদানির জন্য ইতোমধ্যে অগ্রিম টাকাও দিয়েছে সরকার। ভ্যাকসিন বিষয়ক জাতীয় পরিকল্পনা করে মন্ত্রণালয়ে তা জমাও দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর, পাঠানো হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়।
বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর ইতোমধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আনার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও ট্রায়াল ছাড়া এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ ঠিক হবে না।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক জাতীয় পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য যাচাই করে বাংলাদেশে ভ্যাকসিনের নিবন্ধন হবে অনলাইনে। ভ্যাকসিন কেন্দ্র স্থাপনের জন্য ১৫ ধরনের প্রতিষ্ঠানও নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রচলিত টিকাদান কেন্দ্রগুলোও ব্যবহার হবে করোনার টিকা দেওয়ার জন্য।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া- এই সাত দেশের কোনও একটি দেশে যদি ভ্যাকসিন অনুমোদন পায়, তবে তা দেশে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। কিন্তু এ তালিকায় কেবল যুক্তরাজ্যে টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
ভ্যাকসিনের ট্রায়াল হওয়া উচিত কিনা প্রশ্নে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অবশ্যই ট্রায়াল হওয়া উচিত। ট্রায়ালের চেষ্টা চলছে। তবে শেষ পর্যন্ত হবে কিনা তা প্রয়োগ শুরু হলে বলা যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যারা কাজ করছি, তারা মনে করি ট্রায়াল হওয়া উচিত। ট্রায়াল হলে সফল হোক, ব্যর্থ হোক, তাতে একটা অভিজ্ঞতা পাবো। এটা মহামারি নিয়ন্ত্রণে কাজে লাগবে। এমনকি আমাদের এখানে যারা ভ্যাকসিন তৈরি করছেন, তাদের সক্ষমতাও বাড়বে।’
‘আমরা কেবল প্রস্তুতি বলতে কিছু কাগজপত্র দেখতে পাচ্ছি, এর বাইরে কিছু পাচ্ছি না’ এমন মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারতে পর্যন্ত ট্রায়াল হয়েছে। আমাদের দেশে সেটা হলেও বোঝা যেত। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর কী প্রস্তুতি নিচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনের কোনও ট্রায়াল হচ্ছে না। অক্সফোর্ড নিজেরা ট্রায়াল দিয়েছে। আমাদের এখানে কোনও ট্রায়াল হচ্ছে না।’
কিন্তু অবশ্যই দেশে ট্রায়ালের দরকার ছিল মন্তব্য করে আবু জামিল ফয়সাল আরও বলেন, ‘আমরা এখনও জানি না আমাদের দেশে ভ্যাকসিনের রিঅ্যাকশন কী হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, ট্রায়াল ছাড়াই আমরা অনুমোদন দিয়ে দিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশেই ট্রায়াল করে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। আমি বলবো, আমাদের দেশে এর ট্রায়াল অবশ্যই হওয়া উচিত ছিল।’
‘ট্রায়াল হলে অবশ্যই ভালো হতো’ এমনটা বলছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদও। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কিনা, হলে কতটুকু কী হতে পারে, সবই জানা যেত। কারণ, মানুষভেদে টিকার কার্যকারিতা ভিন্ন হয়।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের গঠিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড ডেপ্লয়মেন্ট কোর কমিটির প্রধান ও অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা যেভাবে পরিকল্পনা করেছি, সেভাবে সব করতে পারলে ভ্যাকসিন আসার আগেই প্রস্তুত হয়ে যাবো।’
ট্রায়াল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘সেই অর্থে ট্রায়াল হবে না। আমরা তো সরাসরি কিনছি। তবে আমরা ভাবছি প্রাথমিকভাবে অল্প কিছু দিয়ে দেখবো। পুরো সিস্টেমের সব ঠিকমতো কাজ করছে কিনা। এটা বলতে পারি যে প্রথম এক সপ্তাহে অল্প কিছু ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। তারপর পুরো প্রক্রিয়ায় যাবো। তবে ট্রায়াল হবে না।’
টিকা নিয়ে প্রস্তুতি
এদিকে, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস জানিয়েছে, দেশে ভ্যাকসিন আনা থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার কাজ তারা করবে। এরপর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মাধ্যমে জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হবে।
বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান জানান, পুনেতে অবস্থিত সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা যাবে দিল্লিতে। সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে আসবে ঢাকায়। এ জন্য তারা ঢাকায় ওয়্যারহাউজ তৈরি করেছেন।
নাজমুল হাসান বলেন, আমরা জেলা পর্যন্ত পৌঁছে দেবো। এ জন্য সাতটি বিশেষায়িত গাড়িও কেনা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশজুড়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিপো রয়েছে। যেখানে যেদিন ভ্যাকসিন পৌঁছানোর দরকার হবে, সেখানেই পৌঁছে দেওয়া যাবে। এ জন্য প্রয়োজনে আরও বিশেষায়িত ট্রাক কেনা হবে।
‘টিকা রাখার জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত’ বাংলা ট্রিবিউনকে এমনটা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) পরিচালক আবু হেনা মোর্শেদ জামান। তিনি আরও বলেন, ‘সিএমএসডির আটটি কোল্ড স্টোরেজে দুই থেকে আট ডিগ্রি তাপমাত্রায় টিকা রাখা যাবে। আমার তরফ থেকে কাজ ছিল টাকা পাঠানো। গত ৫ জানুয়ারি আমরা টাকা পাঠিয়েছি সেরাম ইনস্টিটিউটে।’
জানা গেছে, প্রথম দফায় ভ্যাকসিন আসার পর প্রথম ১৫ দিন বেক্সিমকোর নিজস্ব কোল্ডচেইনে সেটা রাখা হবে।
২৪ জানুয়ারির মধ্যে হাম-রুবেলার জন্য রাখা কোল্ডস্টোরেজ প্রায় ফাঁকা হয়ে যাবে। সেখানেই রাখা হবে করোনার ভ্যাকসিন। প্রথম দফায় যে ৫০ লাখ ডোজ আসবে সেগুলো রাখতে কোনও সমস্যা হবে না বলেও জানান আবু হেনা মোর্শেদ জামান।
ইতোমধ্যে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির মাধ্যমে আরও কিছু কোল্ডচেইন জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ আনা হবে বলে জানিয়েছেন আবু হেনা মোর্শেদ জামান। তিনি বলেন, ‘প্রথম দফার পর যদি একবারে আরও বেশি ভ্যাকসিন চলে আসে তার জন্যও আমরা প্রস্তুত।’
করোনার টিকার ক্ষেত্রে এখনও সবকিছুই চ্যালেঞ্জের মধ্যে, এমন মন্তব্য করে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)-এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভ্যাকসিনের প্রাপ্ততার মতো আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আমাদের দেশে এখন ৫০ লাখ টিকা একসঙ্গে রাখার প্রস্তুতি হচ্ছে। এরচেয়ে বেশি দরকার হলে সেটা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে।’
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘টিকা প্রয়োগের শুরুতে অনেক গুজব হবে। অনেকের ভেতরে অসন্তোষ তৈরি হবে। নানা রকম অপপ্রচার হতে পারে। তাই সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে, স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কে টিকা পাচ্ছে, কে পাচ্ছে না, এটা পরিষ্কার থাকলে তাহলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবো।’